লাবুবু পুতুল: ছোট্ট এক পরীর নেশায় কেন মজেছে মানুষ?

labubu doll লাবুবু পুতুল
You are currently viewing লাবুবু পুতুল: ছোট্ট এক পরীর নেশায় কেন মজেছে মানুষ?

হঠাৎ করেই হয়তো আপনার ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুক ফিডে চোখে পড়েছে, লম্বা কান, দুষ্টু একটা হাসি, আর সারিবদ্ধ দাঁত বের করে তাকিয়ে থাকা অদ্ভুত সুন্দর এক পুতুল। কেউ এটাকে চাবির রিং হিসেবে ব্যাগে ঝোলাচ্ছে, কেউ বা পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখছে। এই পুতুলটির নামই লাবুবু পুতুল (Labubu Doll)। কিন্তু কী এই পুতুল? কোত্থেকে এলো? আর কেনই বা বাংলাদেশ ও ভারতের তরুণ-তরুণীরা এর জন্য রীতিমতো পাগল?

চলুন, আজ এই ছোট্ট পরীর পেছনের গল্পটা জেনে নেওয়া যাক।

লাবুবু পুতুল: কোথা থেকে এলো এই মায়াবী চরিত্র?

এর ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়। আসলে, লাবুবু হলো হংকং-এর বিখ্যাত শিল্পী কাসিং লুং (Kasing Lung) এর সৃষ্টি। তিনি “The Monsters” নামে একটি রূপকথার জগৎ তৈরি করেছেন, আর লাবুবু হলো সেই জগতেরই এক দুষ্টু কিন্তু আদুরে পরী (elf)। অনেকেই একে খরগোশ ভাবলেও, এটি আসলে তা নয়।

তবে, এই চরিত্রটিকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় করে তুলেছে চীনের বিখ্যাত পপ কালচার ব্র্যান্ড পপ মার্ট (Pop Mart)। তারাই কাসিং লুং-এর সাথে মিলে এই লাবুবু পুতুল তৈরি এবং বাজারজাত করছে।

জনপ্রিয়তার বিস্ফোরণ: কেন এত মাতামাতি লাবুবু পুতুল নিয়ে?

একটি সাধারণ পুতুলকে ঘিরে এত উন্মাদনার কারণ কী? এর পেছনে বেশ কয়েকটি মনস্তাত্ত্বিক এবং বাণিজ্যিক কারণ রয়েছে।

১. ব্লাইন্ড বক্সের সেই জাদুকরী উত্তেজনা!

লাবুবু পুতুল এর জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড় কারণ হলো এর ‘ব্লাইন্ড বক্স’ মডেল। অর্থাৎ, আপনি যখন একটি বক্স কিনবেন, আপনি জানেন না ভেতরে কোন ডিজাইনের পুতুলটি আছে। বক্সটা খোলার আগ মুহূর্তের সেই বুক ধুকপুকানি, সেই উত্তেজনা – এটাই এর আসল মজা। প্রতিটি সিরিজে ১২টি ভিন্ন ডিজাইন থাকে, আর তার সাথে থাকে একটি ‘সিক্রেট’ বা দুর্লভ ডিজাইন। সেই সিক্রেট পুতুলটি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সংগ্রাহকদের মধ্যে এক ধরনের নেশা তৈরি করে।

২. এটা শুধু খেলনা নয়, এটা একটা স্টাইল স্টেটমেন্ট!

আজকের প্রজন্মের কাছে লাবুবু পুতুল শুধু একটি শোপিস নয়। এটি এখন তাদের ব্যক্তিত্ব ও রুচির পরিচায়ক। ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের ব্যাকপ্যাক, তরুণ পেশাজীবীদের টোট ব্যাগ বা গাড়ির ড্যাশবোর্ডে ঝুলতে থাকা একটি লাবুবু যেন তাদের ফ্যাশনেরই একটি অংশ।

“আমার প্রথম লাবুবু ছিল ‘ফ্রুটস’ সিরিজের একটি স্ট্রবেরি,” বলছিলেন ঢাকার এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাদিয়া। “ওটা পাওয়ার পর থেকে মনে হলো, আমার পুরো সিরিজটা লাগবেই! এখন আমার কালেকশনে প্রায় ২০টা লাবুবু আছে। বন্ধুরা যখন আমার ব্যাগে নতুন কোনো লাবুবু দেখে, তখন ওদের চোখের আগ্রহটা দেখতে আমার দারুণ লাগে।”

সাদিয়ার মতো হাজারো তরুণ-তরুণী এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।

৩. সংগ্রাহকের গর্ব এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রেন্ড

সম্পূর্ণ একটি সিরিজ সংগ্রহ করাটা এখন সংগ্রাহকদের জন্য এক ধরনের গর্বের বিষয়। তাছাড়া, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং টিকটকে এর ‘আনবক্সিং’ ভিডিওগুলো রীতিমতো ভাইরাল। মানুষ অন্যের কালেকশন দেখে অনুপ্রাণিত হয় এবং নিজেরাও এই ট্রেন্ডের অংশ হতে চায়। তৈরি হয়েছে অনলাইন কমিউনিটি, যেখানে ভক্তরা তাদের সংগ্রহ শেয়ার করে, একে অপরের সাথে পুতুল বিনিময় করে এবং নতুন সিরিজ নিয়ে আলোচনা করে।

ব্যবহারকারী কারা? বাজারটা কাদের দখলে?

শুনতে অবাক লাগলেও, লাবুবু পুতুল এর মূল ক্রেতা কিন্তু শিশুরা নয়। এর প্রধান ক্রেতা হলো ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীরা, অর্থাৎ Gen Z এবং Millennials। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া তরুণ পেশাজীবীদের মধ্যেই এই পুতুল কেনার ঝোঁক সবচেয়ে বেশি। তাদের খরচ করার সামর্থ্য এবং নতুন ট্রেন্ড অনুসরণ করার প্রবণতাই এই বাজারকে বড় করে তুলছে।

বাংলাদেশ ও ভারতে লাবুবু পুতুলের বাজার

যেহেতু পপ মার্টের কোনো অফিশিয়াল স্টোর বাংলাদেশ বা ভারতে নেই, তাই এখানে একটি ভিন্ন বাজার তৈরি হয়েছে।

  • অনলাইন পেজ ও গ্রুপ: ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামে অসংখ্য পেজ গড়ে উঠেছে, যারা বিদেশ থেকে, বিশেষ করে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা চীন থেকে এই পুতুলগুলো নিয়ে আসে।

  • প্রি-অর্ডার সিস্টেম: বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রি-অর্ডারের মাধ্যমে এগুলো বিক্রি হয়। একটি নতুন সিরিজ বাজারে আসার ঘোষণা হলেই পেজগুলো অর্ডার নিতে শুরু করে।

  • দাম: অফিশিয়াল দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে এগুলো বিক্রি হয়। একটি ব্লাইন্ড বক্সের দাম যেখানে ৮-১০ ডলার (প্রায় ৯০০-১২০০ টাকা) হওয়ার কথা, সেখানে খুচরা বাজারে এটি ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায়ও বিক্রি হতে দেখা যায়। দুর্লভ বা সিক্রেট পুতুলগুলোর দাম ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকাও ছাড়িয়ে যায়।

সুতরাং, এটি এখন শুধু একটি শখ নয়, কারো কারো জন্য একটি লাভজনক ব্যবসাও বটে।

শেষ পর্যন্ত, লাবুবু পুতুল শুধু একটি প্লাস্টিকের টুকরো নয়। এটি এক টুকরো আনন্দ, একটুখানি উত্তেজনা আর একরাশ স্মৃতি। এটি এমন এক সংস্কৃতি, যা মানুষকে একে অপরের সাথে যুক্ত করছে এবং ডিজিটাল যুগের একঘেয়েমি থেকে সাময়িক মুক্তি দিচ্ছে। এই ছোট্ট পরীর মায়াজালে আপনি একবার জড়িয়ে গেলে, বের হওয়া কিন্তু বেশ কঠিন!

তাহলে, আপনি কি প্রস্তুত আপনার প্রথম ব্লাইন্ড বক্সটি খোলার জন্য? কে জানে, হয়তো ভেতরের সিক্রেট পুতুলটি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছে

Leave a Reply