ইলন মাস্ক । নামটা শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে টেসলার ইলেক্ট্রিক গাড়ি, স্পেসএক্স–এর রকেট, আর মঙ্গলে বসতি গড়ার স্বপ্ন। তিনি একজন জিনিয়াস, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি একাই প্রযুক্তি দুনিয়ার সমীকরণ বদলে দিচ্ছেন। কিন্তু ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আড়ালে তার ব্যক্তিগত জীবন? তা যেন কোনো সায়েন্স ফিকশন সিনেমার চেয়েও বেশি বিস্ময়কর এবং বিতর্কিত। একাধিক প্রেমিকা, ১১ জন সন্তান, আর তাদের এমন সব নাম, যা উচ্চারণ করতেই দাঁত ভেঙে যাওয়ার জোগাড়!
আজ আমরা ডুব দেবো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এই মানুষটির ব্যক্তিগত জীবনের সেই রঙিন ও জটিল অধ্যায়ে। আসুন, খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, কেন তার পারিবারিক জীবন এত বিচিত্র এবং এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোন দর্শন।
শুরুর গল্প: প্রথম প্রেম, প্রথম বিপর্যয়
ইলন মাস্কের সম্পর্কের যাত্রা শুরু হয় জাস্টিন উইলসনের সাথে। তিনি একজন কানাডিয়ান লেখক। কলেজে পড়ার সময় তাদের পরিচয় এবং প্রেম। ২০০০ সালে তারা বিয়ে করেন। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। তবে, ২০০২ সালে তাদের জীবনে নেমে আসে এক ভয়াবহ বিপর্যয়। তাদের প্রথম সন্তান, নেভাডা আলেকজান্ডার মাস্ক, মাত্র ১০ সপ্তাহ বয়সে ‘সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম‘ (SIDS)-এ মারা যায়। এই মর্মান্তিক ঘটনা মাস্ক দম্পতিকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়।
সন্তান হারানোর কষ্টকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকার পাত্র ছিলেন না ইলন। তিনি দ্রুতই আবার বাবা হতে চেয়েছিলেন। এরপর, তারা আইভিএফ (ইন–ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) পদ্ধতির সাহায্য নেন। ২০০৪ সালে তাদের কোল আলো করে আসে যমজ সন্তান গ্রিফিন এবং ভিভিয়ান। এর মাত্র দুই বছর পর, ২০০৬ সালে, তারা আবারও আইভিএফ–এর মাধ্যমে ট্রিপলেট বা তিনজন সন্তানের বাবা–মা হন—কাই, স্যাক্সন এবং ড্যামিয়েন। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে পাঁচ সন্তানের পিতা হয়ে ওঠেন মাস্ক। কিন্তু সম্পর্কের সমীকরণ ততদিনে বদলে গিয়েছিল। ২০০৮ সালে জাস্টিনের সাথে তার ৮ বছরের সংসারের ইতি ঘটে।
হলিউডের ঝলকানি আর ভাঙা–গড়ার খেলা
জাস্টিনের সাথে বিচ্ছেদের পর মাস্কের জীবনে আসেন ব্রিটিশ অভিনেত্রী তালুলাহ রাইলি। তাদের সম্পর্ক ছিল যেন এক রোলার কোস্টার রাইড। ২০১০ সালে তারা বিয়ে করেন। কিন্তু মাত্র দুই বছর পর, ২০১২ সালে, তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তবে, গল্পটা এখানেই শেষ নয়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০১৩ সালে তারা আবার বিয়ে করেন! কিন্তু এই দ্বিতীয় ইনিংসও বেশিদিন টেকেনি। ২০১৬ সালে তারা চূড়ান্তভাবে আলাদা হয়ে যান। তাদের মধ্যে কোনো সন্তান ছিল না, কিন্তু এই বারবার বিয়ে এবং বিচ্ছেদের ঘটনা মাস্কের স্থিতিশীল সম্পর্ক ধরে রাখতে না পারার ইঙ্গিত দেয়।
এর মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য মাস্কের জীবনে এসেছিলেন হলিউডের আরেক বিখ্যাত অভিনেত্রী অ্যাম্বার হার্ড। জনি ডেপের সাথে তার স্ক্যান্ডালপূর্ণ বিচ্ছেদের পর মাস্কের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে অনেক গুঞ্জন তৈরি হয়েছিল। যদিও সেই সম্পর্কও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
সাইবার জগৎ থেকে প্রেম এবং অদ্ভুত নামের সূচনা
মাস্কের জীবনের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায়ের সূচনা হয় কানাডিয়ান মিউজিশিয়ান গ্রাইমস (আসল নাম ক্লেয়ার বাউচার)-এর সাথে। তাদের পরিচয়টাও বেশ অদ্ভুত। টুইটারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটি জোকস করতে গিয়ে মাস্ক দেখেন, গ্রাইমস আগেই সেই জোকটি করে ফেলেছেন। এই ছোট্ট ঘটনা থেকেই শুরু হয় এক ‘সাইবার–রোমান্স‘।
২০২০ সালে গ্রাইমসের গর্ভে মাস্কের ষষ্ঠ সন্তান জন্ম নেয়। আর তখনই সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয় সন্তানের নাম নিয়ে। তারা ছেলের নাম রাখেন X Æ A-12! এই নামের অর্থ বোঝাতে গিয়ে তারা যা ব্যাখ্যা করেন, তা সাধারণ মানুষের মাথার ওপর দিয়ে যাওয়ার মতোই।
- X: হলো একটি অজানা চলক (The unknown variable)।
- Æ: গ্রাইমসের ভাষায় এর অর্থ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ভালোবাসা (Ai – Artificial Intelligence/Love)।
- A-12: তাদের প্রিয় এয়ারক্রাফট SR-71 এর পূর্বসূরি, যার সাংকেতিক নাম ছিল আর্চেঞ্জেল।
অবশ্য, ক্যালিফোর্নিয়ার আইন অনুযায়ী নামে কোনো সংখ্যা ব্যবহার করা যাবে না। তাই তাদের বাধ্য হয়ে নাম বদলে X Æ A-Xiiরাখতে হয়। সংক্ষেপে তাকে ডাকা হয় ‘এক্স‘ (X) নামে।
তবে, এখানেই শেষ নয়। ২০২১ সালে সারোগেসির মাধ্যমে তাদের একটি কন্যা সন্তান হয়, যার নাম রাখা হয় এক্সজা ডার্ক সাইডারিয়েল মাস্ক (Exa Dark Sideræl Musk)। তাকে সংক্ষেপে ডাকা হয় ‘ওয়াই‘ (Y) নামে। সম্প্রতি ওয়াল্টার আইজ্যাকসনের লেখা বায়োগ্রাফি থেকে জানা গেছে, তাদের আরও একটি সন্তান রয়েছে, যার নাম টেকনো মেকানিকাস (Techno Mechanicus), সংক্ষেপে ‘টাউ‘ (Tau)। গ্রাইমসের সাথে মাস্কের সম্পর্কটিও ছিল খুবই অস্থিতিশীল, যা তারা নিজেরাই ‘ফ্লুইড‘ বা পরিবর্তনশীল বলে আখ্যা দিয়েছেন।
গোপন অধ্যায়: নিজের কর্মীর সাথে যমজ সন্তান
যখন সবাই জানতো মাস্ক এবং গ্রাইমসের সম্পর্ক চলছে, তখনই প্রকাশ্যে আসে আরেক বিস্ময়কর তথ্য। মাস্ক তার নিজের কোম্পানি নিউরালিংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা, শিভন জিলিসের সাথে গোপনে যমজ সন্তানের বাবা হয়েছেন। ২০২১ সালের নভেম্বরে আইভিএফ–এর মাধ্যমে জন্ম নেওয়া এই সন্তানদের নাম স্ট্রাইডার (Strider) এবং অ্যাজুর (Azure)। মজার ব্যাপার হলো, এই সন্তানদের জন্মের খবর মাস্ক এবং জিলিস প্রায় এক বছর গোপন রেখেছিলেন।
এত সন্তান, এত ভিন্ন সম্পর্ক – কারণটা কী?
এখন প্রশ্ন হলো, ইলন মাস্কের ব্যক্তিগত জীবন এত জটিল এবং বর্ণিল কেন? কেন তিনি এতগুলো সন্তানের পিতা হতে চান? এর উত্তর লুকিয়ে আছে তার নিজস্ব জীবনদর্শনে।
ইলন মাস্ক বহুবার জনসমক্ষে বলেছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হলো জনসংখ্যা হ্রাস (Underpopulation Collapse)। তিনি মনে করেন, উন্নত দেশগুলোতে জন্মহার যেভাবে কমছে, তা মানব সভ্যতার জন্য একটি ভয়াবহ হুমকি। তিনি বিশ্বাস করেন, মেধাবী এবং সক্ষম মানুষদের আরও বেশি সন্তান জন্ম দেওয়া উচিত, যাতে মানব প্রজাতি টিকে থাকতে পারে এবং বিকশিত হতে পারে। মূলত, তার কাছে বেশি সন্তানের জন্ম দেওয়া মানবজাতির প্রতি এক ধরনের দায়িত্ব পালন করার সামিল। তিনি নিজের বিশাল সম্পদ এবং বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে মানবজাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে চান, আর এই দর্শনেরই একটি অংশ হলো তার এই বৃহৎ পরিবার।
ইলন মাস্ক এর সাথে সন্তানের দূরত্ব: এক ভিন্ন বাস্তবতা
যদিও মাস্ক নিজেকে একজন আদর্শ পিতা হিসেবে প্রমাণ করতে চান, তার সব সন্তান কিন্তু তার সাথে একমত নয়। তার প্রথম স্ত্রীর গর্ভের সন্তান ভিভিয়ান, যিনি একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী, ১৮ বছর বয়সে আইনত নিজের নাম পরিবর্তন করে ভিভিয়ান জেনা উইলসন রাখেন। তিনি তার মায়ের বংশপরিচয় গ্রহণ করেন এবং বাবার সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার আবেদন জানান। তিনি আদালতে বলেন, “আমি আর কোনোভাবেই আমার জৈবিক পিতার সাথে সম্পর্কিত থাকতে চাই না।” এই ঘটনা মাস্কের পারিবারিক জীবনের এক অন্ধকার দিককে তুলে ধরে, যা দেখায় যে তার সব সন্তানের সাথে তার সম্পর্ক মধুর নয়।
শেষ কথা
সব মিলিয়ে, ইলন মাস্ক একজন সাধারণ মানুষ নন। তার চিন্তাভাবনা, তার কাজ, এমনকি তার ব্যক্তিগত জীবন—সবকিছুই যেন প্রথা ভাঙার এক একটি গল্প। তার একাধিক সম্পর্ক হয়তো তার স্থিতিশীলতার অভাবকে নির্দেশ করে, কিন্তু তার ১১ জন সন্তান তার গভীর এক দর্শনেরই প্রতিফলন। তিনি এমন এক ভবিষ্যৎ গড়তে চান, যেখানে মানবজাতি মহাকাশে ছড়িয়ে পড়বে, আর সেই ভবিষ্যতের জন্য চাই আরও অনেক মানুষ।
তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কেউ তাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলতে পারেন, আবার কেউ হয়তো তার দূরদৃষ্টির প্রশংসা করবেন। তবে, একটা কথা নিশ্চিত, ইলন মাস্ক এমন একজন মানুষ যিনি নিজের তৈরি করা নিয়মেই বাঁচেন। তার জীবন যেন আমাদের এই বার্তা দেয়—সাধারণের ভিড়ে অসাধারণ হতে হলে, ভাবনার গণ্ডিটাকেও পেরিয়ে যেতে হয়। তার এই বিচিত্র জীবনযাত্রা হয়তো সেই অসাধারণ হওয়ারই এক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।